ঢাকা ০১:২৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সব খাতে দুর্নীতি রোধ প্রধান উপদেষ্টাকে নানা প্রশ্ন ও পরামর্শ শিক্ষার্থীদের

ভোরের দিগন্ত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় : ০৩:৩২:০২ অপরাহ্ন, সোমবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৪১ বার পঠিত

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মতবিনিময় সভা যেন পরিণত হলো জবাবদিহি দেওয়া-নেওয়ার অনুষ্ঠানে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলেন শিক্ষার্থীরা। উপদেষ্টারাও দিলেন তার জবাব। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাঙ্গনে সংস্কারের মাধ্যমে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনা, ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন আয়োজন, গণহত্যার দায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার, গণপিটুনিতে লোকজনকে হত্যা ও মারধরের মতো ঘটনা থামানো, ভারতের সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতি কী হবে তা স্পষ্ট করা, ভারত সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা বন্ধে সরকার কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে– এ রকম অনেক বিষয়েই চলে প্রশ্নোত্তর। শিক্ষার্থীরা দেন তাদের পরামর্শও। কোনো বিশেষ বিষয় ধরে নয়; যে যার মতো বিষয়ে প্রশ্ন করেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন।

গতকাল রোববার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের শাপলা হলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এ মতবিনিময় সভা হয়। স্বৈরাচারের পতন আন্দোলনে মাঠে থেকে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের সঙ্গে এটি ছিল ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রথম আলাপ। এ সময় অনেকে বক্তব্য দিতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। প্রধান উপদেষ্টাকেও একসময় কাঁদতে দেখা যায়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এমন পাঁচজন সমন্বয়কের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

দাযিত্বশীল সূত্র জানায়, মতবিনিময় অনুষ্ঠানে ৯০ জন শিক্ষার্থী থাকার কথা থাকলেও পরে এ সংখ্যা দেড়শ ছাড়িয়ে যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা ছিলেন। পাশাপাশি ব্র্যাক, নর্থ সাউথ, উত্তরা, ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ জন শিক্ষার্থী এতে অংশ নেন। এ ছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সাত কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা এতে অংশ নেন।

কী হলো আলোচনা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী আশরেফা খাতুন সমকালকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার কাজে মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। বিচারবহির্ভূত কোনো ঘটনা যেন না ঘটে, সেদিকেও নজর রাখতে বলেছেন শিক্ষার্থীরা। দ্রুততম সময়ে গণহত্যায় জড়িতদের বিচারের ব্যবস্থা করা দরকার। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও এর সঙ্গে একমত পোষণ করেন এবং কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে তা তুলে ধরেন। আসিফ নজরুল বলেন, এমনভাবে কাজ করা হচ্ছে, যেন বিচার ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা ফিরে আসে। বিচার প্রক্রিয়ায় কালক্ষেপণ হবে না আগের মতো।

এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়ার সংস্কারও চান শিক্ষার্থীরা। মেডিকেল, বুয়েটসহ যারা এসব বিষয়ে পড়েন এবং একসময় দেশ ছেড়ে একেবারেই চলে যান। এই মেধা পাচারটা যেন না হয়, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। মেডিকেলে ভর্তির প্রশ্নপত্র ও প্রক্রিয়ার মধ্যে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন ছাত্রছাত্রীরা।
শিক্ষার্থী আশরেফা খাতুন বলেন, যেহেতু আমরা শিক্ষার্থী, এর কারণে দেশের রাজনীতি ও আগামী জাতীয় নির্বাচন– এসব বিষয় নিয়ে তেমন আলাপ হয়নি। কিন্তু সব দলমত ও ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ আমাদের সমাজে থাকবে– এটি বলেছেন শিক্ষার্থীরা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও ইডেন মহিলা কলেজ শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান ইমু প্রশ্নোত্তর পর্বে শেখ হাসিনার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে জানতে চান। জবাবে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের একটি চুক্তি রয়েছে। যেহেতু তারা আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র, তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধান বের করা হবে।

আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের সম্মান দেওয়া নিয়ে এক শিক্ষার্থীর প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যাদের সন্তান শহীদ হয়েছে, একটি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তাদের সর্বোচ্চ সম্মান প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তারা যেন না মনে করতে পারেন যে সন্তান হারিয়েছেন– এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম সমকালকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মতবিনিময় হলো। আগামীতেও এ প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে।
তিনি বলেন, শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ, ছাত্র সংসদ নির্বাচন, মব জাস্টিস না করা, মাজার না ভাঙাসহ অনেক কথাই উঠে এসেছে। মূলত যেটা হলো প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে, আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের একটা যোগাযোগ তৈরি হলো।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সম্মান ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে বিকেলে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম সাংবাদিকদের জানান, সকালের অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের এক প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়ে বর্তমান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন ড. ইউনূস। তিনি প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সম্মান ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে হবে বলে শিক্ষার্থীদের জানান।
মাহফুজ আলম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে সার্ক পুনরুজ্জীবনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার কাজ করতে আগ্রহী।
তিনি আরও বলেন, সরকারের এক মাস পূরণের অংশ হিসেবে এই আলোচনা। এখানে আবেগ-অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন সবাই। এ ছাড়া আলোচনা হয়েছে কীভাবে কোন কোন সেক্টরে সংস্কার প্রয়োজন তা নিয়ে।

তিনি আরও বলেন, ক্যাম্পাসে কী ধরনের রাজনীতি হবে, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি হোক– এটা তারা চান না। রাজনৈতিক কোনো ট্যাগ শিক্ষাঙ্গনে চান না তারা। পাশাপাশি পিটিয়ে হত্যা বন্ধ করার কথা বলেছেন শিক্ষার্থীরা।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করার বিষয়টি এনেছেন। এ ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক থাকার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। সরকারপ্রধান সেটি শুনেছেন কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত জানাননি। মাহফুজ আলম বলেন, সেখানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নয়, আলোচনা হয়েছে ধর্মকে নিয়ে অপরাজনীতি করার বিষয়ে।
মাহফুজ আলম বলেন, যারা এতদিন নানা প্ল্যাটফর্মে আসতে পারেননি, তাদের আজ ডাকা হয়েছে। ধীরে ধীরে বাকিদের ডাকা হবে। সবাই সরকারকে তাদের পরামর্শ দেবেন। সেই সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হবে।

আহত-নিহতের তালিকা তৈরির বিষয়ে প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম বলেন, ১৮ হাজার মানুষ আহত হয়েছে। আমরা সবার ঠিকানা নিচ্ছি। এবার ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ছিল।
সরকারের তরফ থেকে আহত ও নিহতের বিচারের ক্ষেত্রে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সে বিষয় গুলো আলোচনা হয়েছে। একটি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে কাজটি দ্রুত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে শহীদ পরিবারকে ক্ষতিপূরণ, আহত পরিবারকে পুনর্বাসন ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

গতকাল রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় শুরু হয়ে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত চলে এ মতবিনিময় অনুষ্ঠান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিকেল ও মাদ্রাসার ছয় শিক্ষার্থী বক্তব্য দেন। উপদেষ্টাদের পর্বে স্বাগত বক্তব্য দেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। পরে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বক্তব্য দেন। সব শেষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বক্তব্য দেন।
প্রশ্নোত্তর পর্বে শিক্ষার্থীরা ভারত সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ জানতে চান। পরে কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির প্রধান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. মাহফুজ আলম।

মতবিনিময়ে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য প্যাকেটজাত খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। মতবিনিময় শেষে কুশল বিনিময় ও উপদেষ্টাদের সঙ্গে ছবি তোলেন শিক্ষার্থীরা। পরে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের বড় তিনটি বাসে করে শিক্ষার্থীরা বের হয়ে যান।

ট্যাগস :

সব খাতে দুর্নীতি রোধ প্রধান উপদেষ্টাকে নানা প্রশ্ন ও পরামর্শ শিক্ষার্থীদের

আপডেট সময় : ০৩:৩২:০২ অপরাহ্ন, সোমবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মতবিনিময় সভা যেন পরিণত হলো জবাবদিহি দেওয়া-নেওয়ার অনুষ্ঠানে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলেন শিক্ষার্থীরা। উপদেষ্টারাও দিলেন তার জবাব। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাঙ্গনে সংস্কারের মাধ্যমে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনা, ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন আয়োজন, গণহত্যার দায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার, গণপিটুনিতে লোকজনকে হত্যা ও মারধরের মতো ঘটনা থামানো, ভারতের সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতি কী হবে তা স্পষ্ট করা, ভারত সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা বন্ধে সরকার কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে– এ রকম অনেক বিষয়েই চলে প্রশ্নোত্তর। শিক্ষার্থীরা দেন তাদের পরামর্শও। কোনো বিশেষ বিষয় ধরে নয়; যে যার মতো বিষয়ে প্রশ্ন করেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন।

গতকাল রোববার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের শাপলা হলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এ মতবিনিময় সভা হয়। স্বৈরাচারের পতন আন্দোলনে মাঠে থেকে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের সঙ্গে এটি ছিল ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রথম আলাপ। এ সময় অনেকে বক্তব্য দিতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। প্রধান উপদেষ্টাকেও একসময় কাঁদতে দেখা যায়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এমন পাঁচজন সমন্বয়কের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

দাযিত্বশীল সূত্র জানায়, মতবিনিময় অনুষ্ঠানে ৯০ জন শিক্ষার্থী থাকার কথা থাকলেও পরে এ সংখ্যা দেড়শ ছাড়িয়ে যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা ছিলেন। পাশাপাশি ব্র্যাক, নর্থ সাউথ, উত্তরা, ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ জন শিক্ষার্থী এতে অংশ নেন। এ ছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সাত কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা এতে অংশ নেন।

কী হলো আলোচনা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী আশরেফা খাতুন সমকালকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার কাজে মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। বিচারবহির্ভূত কোনো ঘটনা যেন না ঘটে, সেদিকেও নজর রাখতে বলেছেন শিক্ষার্থীরা। দ্রুততম সময়ে গণহত্যায় জড়িতদের বিচারের ব্যবস্থা করা দরকার। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও এর সঙ্গে একমত পোষণ করেন এবং কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে তা তুলে ধরেন। আসিফ নজরুল বলেন, এমনভাবে কাজ করা হচ্ছে, যেন বিচার ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা ফিরে আসে। বিচার প্রক্রিয়ায় কালক্ষেপণ হবে না আগের মতো।

এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়ার সংস্কারও চান শিক্ষার্থীরা। মেডিকেল, বুয়েটসহ যারা এসব বিষয়ে পড়েন এবং একসময় দেশ ছেড়ে একেবারেই চলে যান। এই মেধা পাচারটা যেন না হয়, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। মেডিকেলে ভর্তির প্রশ্নপত্র ও প্রক্রিয়ার মধ্যে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন ছাত্রছাত্রীরা।
শিক্ষার্থী আশরেফা খাতুন বলেন, যেহেতু আমরা শিক্ষার্থী, এর কারণে দেশের রাজনীতি ও আগামী জাতীয় নির্বাচন– এসব বিষয় নিয়ে তেমন আলাপ হয়নি। কিন্তু সব দলমত ও ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ আমাদের সমাজে থাকবে– এটি বলেছেন শিক্ষার্থীরা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও ইডেন মহিলা কলেজ শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান ইমু প্রশ্নোত্তর পর্বে শেখ হাসিনার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে জানতে চান। জবাবে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের একটি চুক্তি রয়েছে। যেহেতু তারা আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র, তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধান বের করা হবে।

আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের সম্মান দেওয়া নিয়ে এক শিক্ষার্থীর প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যাদের সন্তান শহীদ হয়েছে, একটি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তাদের সর্বোচ্চ সম্মান প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তারা যেন না মনে করতে পারেন যে সন্তান হারিয়েছেন– এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম সমকালকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মতবিনিময় হলো। আগামীতেও এ প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে।
তিনি বলেন, শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ, ছাত্র সংসদ নির্বাচন, মব জাস্টিস না করা, মাজার না ভাঙাসহ অনেক কথাই উঠে এসেছে। মূলত যেটা হলো প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে, আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের একটা যোগাযোগ তৈরি হলো।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সম্মান ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে বিকেলে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম সাংবাদিকদের জানান, সকালের অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের এক প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়ে বর্তমান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন ড. ইউনূস। তিনি প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সম্মান ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে হবে বলে শিক্ষার্থীদের জানান।
মাহফুজ আলম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে সার্ক পুনরুজ্জীবনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার কাজ করতে আগ্রহী।
তিনি আরও বলেন, সরকারের এক মাস পূরণের অংশ হিসেবে এই আলোচনা। এখানে আবেগ-অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন সবাই। এ ছাড়া আলোচনা হয়েছে কীভাবে কোন কোন সেক্টরে সংস্কার প্রয়োজন তা নিয়ে।

তিনি আরও বলেন, ক্যাম্পাসে কী ধরনের রাজনীতি হবে, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি হোক– এটা তারা চান না। রাজনৈতিক কোনো ট্যাগ শিক্ষাঙ্গনে চান না তারা। পাশাপাশি পিটিয়ে হত্যা বন্ধ করার কথা বলেছেন শিক্ষার্থীরা।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করার বিষয়টি এনেছেন। এ ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক থাকার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। সরকারপ্রধান সেটি শুনেছেন কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত জানাননি। মাহফুজ আলম বলেন, সেখানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নয়, আলোচনা হয়েছে ধর্মকে নিয়ে অপরাজনীতি করার বিষয়ে।
মাহফুজ আলম বলেন, যারা এতদিন নানা প্ল্যাটফর্মে আসতে পারেননি, তাদের আজ ডাকা হয়েছে। ধীরে ধীরে বাকিদের ডাকা হবে। সবাই সরকারকে তাদের পরামর্শ দেবেন। সেই সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হবে।

আহত-নিহতের তালিকা তৈরির বিষয়ে প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম বলেন, ১৮ হাজার মানুষ আহত হয়েছে। আমরা সবার ঠিকানা নিচ্ছি। এবার ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ছিল।
সরকারের তরফ থেকে আহত ও নিহতের বিচারের ক্ষেত্রে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সে বিষয় গুলো আলোচনা হয়েছে। একটি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে কাজটি দ্রুত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে শহীদ পরিবারকে ক্ষতিপূরণ, আহত পরিবারকে পুনর্বাসন ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

গতকাল রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় শুরু হয়ে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত চলে এ মতবিনিময় অনুষ্ঠান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিকেল ও মাদ্রাসার ছয় শিক্ষার্থী বক্তব্য দেন। উপদেষ্টাদের পর্বে স্বাগত বক্তব্য দেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। পরে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বক্তব্য দেন। সব শেষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বক্তব্য দেন।
প্রশ্নোত্তর পর্বে শিক্ষার্থীরা ভারত সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ জানতে চান। পরে কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির প্রধান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. মাহফুজ আলম।

মতবিনিময়ে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য প্যাকেটজাত খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। মতবিনিময় শেষে কুশল বিনিময় ও উপদেষ্টাদের সঙ্গে ছবি তোলেন শিক্ষার্থীরা। পরে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের বড় তিনটি বাসে করে শিক্ষার্থীরা বের হয়ে যান।